BN/Prabhupada 0617 - কোন নতুন সূত্র নেই, এটি সেই একই ব্যাসপূজা, একই দর্শন।



His Divine Grace Srila Bhaktisiddhanta Sarasvati Gosvami Prabhupada's Disappearance Day, Lecture -- Hyderabad, December 10, 1976

শ্রীল প্রভুপাদঃ ৪০ বৎসর পূর্বে। আমার মনে আছে সেই ১৯২২ সালে ঠিক যেমনটা হয়েছিল, এবং সেই একই ব্যপার এখনও চলছে। আমাদের নতুন কিছু করার নেই। ঠিক যেমনটা আছে সেভাবেই আমাদেরকে এটি উপস্থাপন করতে হবে, তাহলেই সাফল্য আসবে। ভিন্ন কিছু নেই, দেখতে পারছো। আমার লেখার উৎসাহটিও একই রয়ে গেছে। "আমরা ভ্রান্তভাবে পরিচালিত, তাই সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে।" এই আত্মার হননকারী সভ্যতা আমাদের ভুল পথে পরিচালিত করছে। আমাদের অবশ্যই এটি জানতে হবে যে এটি এক উদ্ভ্রান্ত সভ্যতা। আমাদের জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য হল আমাদের পারমার্থিক পরিচয়টি বোঝা। এবং শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খুঁজে বার করা। সেটিই আমাদের প্রকৃত কর্তব্য। কিন্তু এই আধুনিক সভ্যতা আমাদেরকে ভিন্নপথে পরিচালিত করছে। তাই আমি লিখেছিলাম, "মায়ার প্রভাবে আপন স্বভাবে সদাই অধম মতি, ত্রাণ কর এই অধম জনেরে, কৃপা বিনা নাহি গতি জীব কল্যাণে তব অবদান জগতে ঘোষিত আজ, তব শ্রীচরণ আমার জীবন গুরুদেব মহারাজ।" এই অংশটি তিনি অত্যন্ত প্রশংসা করেছিলেন।

আমাদেরকে খুঁজে বার করতে হবে যে কিভাবে আমরা স্রোতের বিপরীতে চলতে পারি। এখন স্রোত হচ্ছে ইন্দ্রিয় ভোগের দিকে। জাগতিক জীবন মানে হচ্ছে ইন্দ্রিয় সুখভোগের স্রোত। এবং এই স্রোতকে বিপরীতমুখী করতে হবে - শ্রীকৃষ্ণের ইন্দ্রিয় পরিতৃপ্তি করতে হবে। ইন্দ্রিয় উপভোগ রয়েছে, কিন্তু জাগতিক উদ্ভ্রান্ত সভ্যতা, এই ইন্দ্রিয় সুখভোগকে ব্যক্তিগত স্বার্থে লাগাচ্ছে। যখন এই ইন্দ্রিয় তৃপ্তির বাসনা শ্রীকৃষ্ণের দিকে মোড় নেবে, তখন আমাদের জীবন সফল হবে। গোপীগণের মতো। আপাতদৃষ্টিতে এইসব গোপীগণ, তাঁরা একজন যুবক শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আসক্ত। যেন তাদের ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য তাঁরা শ্রীকৃষ্ণের সাথে বন্ধুত্ব করেছিলেন। না। আসলে তা নয়। আসল ব্যপারটি হল গোপীরা নিজেদের অত্যন্ত সুন্দরভাবে সজ্জিত করতেন, কারণ তাঁদের দিকে দেখে শ্রীকৃষ্ণ সন্তুষ্ট হবেন, তাঁদের নিজেদের ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য নয়। সাধারণত একটি মেয়ে সাজসজ্জা করে একটি ছেলেকে আকৃষ্ট করতে। সেই একইভাবে তাঁরাও করছেন, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের প্রীতিবিধানের জন্য, গোপীদের নিজেদের জন্য নয়। গোপিকারা আর কিছুই চান নি, শুধু কৃষ্ণসন্তুষ্টি। এই হচ্ছে কাম এবং প্রেমের পার্থক্য। প্রেম রয়েছে, কিন্তু প্রেম তখনই সম্ভব যখন তা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি নিবেদিত হয়। সেটি হচ্ছে প্রেম। আর তার নীচে যা কিছু- সবকিছুই কাম। সুতরাং এটি আমাদের সর্বদা মনে রাখতে হবে। ইন্দ্রিয়গুলি স্তব্ধ করা যায় না, কিন্তু যখন তা শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টির জন্য যুক্ত হয় , তা ভক্তি বা প্রেমে পরিণত হয়। আর যখন ইন্দ্রিয়তৃপ্তি নিজের জন্য প্রয়োগ করা হয়, তাই-ই কামে রূপান্তরিত হয়। এই হচ্ছে কাম এবং প্রেমের মধ্যকার পার্থক্য। শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর এই কৌশলটি জানতেন, কিভাবে আমাদের কার্যকলাপ শ্রীকৃষ্ণের প্রীতি বিধানে রূপান্তরিত করতে হয়। এই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন। তাই আমি লিখেছিলাম... জীব কল্যাণে তব অবদান জগতে ঘোষিত আজ, তব শ্রীচরণ আমার জীবন গুরুদেব মহারাজ।"

আমরা পতিত জীবেরা শ্রীকৃষ্ণ ভুলে গিয়েছি। "আমরা কেন পতিত?" কারণ আমরা ভুলে গিয়েছি... শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নিত্য। যদি এটি নিত্য নাই হতো, তাহলে কিভাবে তোমরা পাশ্চাত্যের লোকেরা কৃষ্ণভক্ত হলে? কৃত্রিমভাবে শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত হওয়া যায় না। সম্পর্কটি চিরন্তন। নিত্য-সিদ্ধ কৃষ্ণভক্তি। সঠিক পন্থার দ্বারা তা এখন জাগরিত হয়েছে। শ্রবণাদি শুদ্ধচিত্তে করয়ে উদয় (চৈতন্য চরিতামৃত ২২.১০৭)। এটি জাগরিত হয়েছে। একটি যুবক আর যুবতীর মাঝে ভালোবাসাটি কৃত্রিম নয়, এটি রয়েছে। কিন্তু কিছু নির্দিষ্ট অবস্থা বা পরিবেশে সেই ভালোবাসা প্রকাশ পায়। একই রকম ভাবে, শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আমাদের প্রেম নিত্য। জীবের স্বরূপ হয় নিত্য কৃষ্ণ-দাস (চৈতন্য চরিতামৃত ২০.১০৮-১০৯) কিন্তু আমাদের এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে যাতে করে সেই নিত্য সম্পর্কটি জাগ্রত হয়। সেটিই হচ্ছে কৌশল। সেটিই প্রয়োজন। "কৃষ্ণকে ভুলে মায়ার কবলে ক্লেশ পাই অবিরত, মরুভূমি মাঝে মৃগতৃষা সম প্রলোভন ভরে হত।" যেহেতু আমরা শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে গিয়েছি, তাই আমাদের এতো কঠিন শাস্তি পেতে পেতে হচ্ছে, এতো দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সেই ভোগান্তিটি কি? সেটি হচ্ছে নিবর্তন্তে মৃত্যু-সংসার বর্ত্মনি (গীতা ৯.৩) এই মানব জীবনটি শ্রীকৃষ্ণ উপলব্ধির জন্য, কিন্তু কৃষ্ণোপলব্ধির পরিবর্তে আমরা ইন্দ্রিয়তৃপ্তির জন্য তথাকথিত জড় বিজ্ঞান উপলব্ধির চেষ্টা করছি। এই হচ্ছে আমাদের অবস্থা। শ্রীকৃষ্ণকে বোঝার জন্য প্রকৃতি আমাদের যেই ক্ষমতা দিয়েছিল, তা আমরা নিযুক্ত করছি কিভাবে ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য কিছু জড়বস্তু আবিষ্কার করা যায় তার পেছনে। এই সবই চলছে। এই হচ্ছে মায়া। অতএব আমাদের এতো মায়ার কবলে যন্ত্রণা পেতে হচ্ছে। যন্ত্রণা পাচ্ছি। কারণ শ্রীকৃষ্ণ ভুলে গিয়েছি। সেই জন্যই আমরা এখন আণবিক অস্ত্র তৈরি করেছি - রাশিয়া, আমেরিকা আর তোমাদের সকলকে এর চড়া মূল্য দিতে হবে। তারা ইতিমধ্যেই অনেক মূল্য দিচ্ছে। সামরিক প্রস্তুতি চলছে। দেশের শতকরা ৫০ ভাগেরও অধিক উপার্জন এই সামরিক খাতে ব্যয় করা হচ্ছে ... দারুণভাবে। অন্য কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার পরিবর্তে, এটি সামরিক শক্তি অর্জনের পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে। প্রতিটি রাষ্ট্র তা করছে। এভাবে আমরা অত্যন্ত কঠিন মূল্য দিচ্ছি। আর যখন যুদ্ধ হয় তখন কোনও সীমা থাকে না, এই ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে আমরা কতোই না অপচয় করছি। কেন? কারণ আমরা শ্রীকৃষ্ণ ভুলে গিয়েছি। এই হচ্ছে বাস্তব সত্য। এই সমস্ত লোকেরা রাষ্ট্রসংঘ বানিয়েছে, আর অনর্থক কুকুরের ন্যায় ঘেউ ঘেউ করছে। সুতরাং এইসব দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। সমস্যার সমাধান তখন হবে যখন তারা একটি বিষয় পাশ করবে যে এই বিশ্ব, শুধু এই বিশ্বই নয়... শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, সর্ব লোক মহেশ্বরম্ (গীতা ৫.২৯) শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছে সব কিছুর অধীশ্বর, তাহলে কেন সেটি মেনে নিচ্ছ না? প্রকৃতপক্ষে তিনি হচ্ছেন মালিক। এই গ্রহ কে বানিয়েছে? আমরা বানিয়েছি না কি আমাদের বাবারা বানিয়েছে? না। শ্রীকৃষ্ণ বানিয়েছেন। কিন্তু আমরা দাবী করছি, এই অংশটি হচ্ছে আমেরিকানদের, এটি ভারতীয়দের, এই অংশ পাকিস্তানীদের। শুধু শুধু। এইসব দাবীর কি মূল্য আছে? হয়তো আমরা পঞ্চাশ, ষাট বড়জোর একশ বছরের জন্য এসব দাবী করতে পারি। আর তারপর। একটা লাথি, "বেরিয়ে যাও"। কোথায় থাকবে তোমাদের দাবী? কিন্তু তারা এই দর্শনটি বুঝতে চায় না। ওরা শুধু লড়াই করছে। ব্যাস। এটি আমার, এটি আমার দেশ, এটি আমার দেশ। তারা জানে না, শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, তথা দেহান্তরপ্রাপ্তিঃ (গীতা ২.১৩) "তুমি আজকে আমেরিকান, কালকে যদি তুমি আমেরিকার মধ্যেও জন্মাও, একটি আমেরিকান গরু অথবা আমেরিকান প্রাণী হয়ে, কেউ তোমাকে পাত্তাও দেবে না। কেউই তোমার এই রাজনীতির তোয়াক্কাও করবে না। কিন্তু এই কৌশলটি তারা জানে না। এই বিজ্ঞানটি তারা জানে না। ওরা অজ্ঞানতার মধ্যে রয়েছে। ওরা ভাবছে, "আমি চিরকাল আমেরিকান হয়েই থাকবো। তাই আমেরিকার স্বার্থের জন্য আমার সময় নষ্ট করা উচিত।" তথাকথিত স্বার্থ। কোনও স্বার্থ থাকতে পারে না। প্রকৃতে ক্রিয়মানানি গুণৈঃ কর্মাণি সর্বশঃ (গীতা ৩.২৭) সবকিছুই প্রকৃতির দ্বারা ঘটছে। আর আমরা অনর্থক মিথ্যাভাবে ভাবছি, অহঙ্কার বিমূঢ়াত্মা কর্তাহম্ ইতি মন্যতে। এইসব মায়াই চলছে। "কৃষ্ণকে ভুলে মায়ার কবলে ক্লেশ পাই অবিরত, মরুভূমি মাঝে মৃগতৃষা সম প্রলোভন ভরে হত।" বিভীষিকা ভরা অন্ধ তিমির অমানিশা সম মানি, মম আশা আজ গুরু মহারাজ তব শ্রীমুখের বাণী। এই বার্তা। আমরা অজ্ঞান অন্ধকারে রয়েছি। আমরা পরে আবার আলোচনা করব। এখন শুধু... এখন সময় কত হল? ভক্তবৃন্দঃ পৌনে ন'টা। শ্রীল প্রভুপাদঃ হুম? ভক্তবৃন্দঃ পৌনে ন'টা। প্রভুপাদঃ হ্যাঁ। তাহলে আমরা পরে আবার আলোচনা করব। একই জিনিস শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা পরিকল্পিত। পরম্পরার মাধ্যমে আমরা এই দর্শন বুঝতে পেরেছি। এবম্ পরম্পরা প্রাপ্তমিমং রাজর্ষয়ো বিদুঃ (গীতা ৪.২) । তাই এই পরম্পরা পদ্ধতিটি চালিয়ে যাও। এই ব্যাসপুজা হল পরম্পরা পন্থা। ব্যাসপূজা মানে হচ্ছে পরম্পরা পন্থা স্বীকার করে নেয়া। গুরুদেব হলেন ব্যাসদেবের প্রতিনিধি কারণ তিনি কিছু পরিবর্তন করেন না। ব্যাসদেব যা বলেছেন, তোমার গুরুও তাই বলবেন। এমন নয় যে, "এতো হাজার বছর পেরিয়ে গেছে, সুতরাং আমি নতুন কিছু দেব"। কোন নতুন সুত্র নেই। সেই একই ব্যাসপূজা। একই দর্শন। আমাদের শুধু সেটি গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই আমাদের জীবন সার্থক হবে।

সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।

ভক্তবৃন্দঃ জয়।