BN/Prabhupada 0647 - যোগ মানে পরমেশ্বরের সাথে সংযুক্ত হওয়া



Lecture on BG 6.2-5 -- Los Angeles, February 14, 1969

ভক্তঃ শ্লোক সংখ্যা ৪। "তাকেই যোগারুঢ় বলা যায়, যখন তিনি সমস্ত জড় বাসনা ত্যাগ করেছেন, যখন তিনি ইন্দ্রিয় সুখভোগের জন্য কর্ম করেন না এবং সকাম কর্মে লিপ্ত হন না। (গীতা ৬.৪)

শ্রীল প্রভুপাদঃ হ্যাঁ। এটিই হচ্ছে যোগ অনুশীলনের সিদ্ধির পর্যায়। একজন ব্যক্তি তখন যোগের স্তরে উন্নীত হন। যোগ মানে হচ্ছে সংযুক্ত হওয়া। ঠিক একই উদাহরণ। ধর, আমার এই আঙ্গুলটি আমার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। অথবা আঙ্গুল নয়, ধর একটি যন্ত্রের অংশ। এটি যন্ত্র থেকে আলাদা হয়ে পড়ে আছে। আর যেই মাত্র তুমি এটিকে মূল যন্ত্রের সঙ্গে জুড়ে দিবে, এটি বিভিন্ন ধরণের কাজে লাগবে। কাটাকাট, কাটাকাট, কাটাকাট... এটি কাজ করতে থাকবে। অর্থাৎ এটি যুক্ত হয়েছে। ঠিক তেমনই, আমরা এখন আলাদা হয়ে রয়েছি। এইসব জড় কার্যকলাপ, সকাম কর্ম, বলা হয়েছে এগুলো শুধু সময়ের অপচয় মাত্র। মূঢ়, মূঢ়। তাদেরকে ভগবদগীতায় মূঢ় বলে সম্বোধন করা হয়েছে। মূঢ় মানে মূর্খ। কেন? এতো বড় একজন ব্যবসায়ী? তাকে তুমি মূর্খ বলছো কেন? সে রোজ লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করছে। কিন্তু তাদের মূর্খ বলে বর্ণনা করা হয়েছে, মূর্খ। কারণ তারা এতো কঠোর পরিশ্রম করছে, কিন্তু সে কি উপভোগ করতে পারছে? সে তো সেই একই পরিমাণ আহার, নিদ্রা, মৈথুন উপভোগ করছে। ব্যাস। একজন ব্যক্তি দিনে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করছে মানে এই নয় যে সে লক্ষ লক্ষ স্ত্রীলোক উপভোগ করতে পারছে। না। সেটি সম্ভব নয়। তার যৌনসুখভোগ করার ক্ষমতা যে লোকটি পাঁচ'শ টাকা উপার্জন করছে তার মতোই। তার আহার করার ক্ষমতা যে লোকটি পাঁচশ টাকা উপার্জন করছে তার মতোই। তবুও সে কখনও ভাবে না যে, "যে লোকটি পাঁচশ টাকা উপার্জন করছে তার উপভোগ করার ক্ষমতা আর আমার উপভোগ করার ক্ষমতা তো একই। তাহলে আমি কেন রোজ লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জনের জন্য এতো কঠোর পরিশ্রম করছি? আমি কেন আমার শক্তিকে এভাবে নষ্ট করছি?" বুঝলে? এদের বলা হয় মূঢ়।

ন মাম্ দুষ্কৃতিনঃ (BG 7.15) - আসলে তার উচিৎ ছিল, যখন সে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করছে, তার উচিৎ ছিল নিজের দেহ, সময় ও শক্তিকে এমনভাবে নিযুক্ত করা যাতে করে সে ভগবানকে বুঝতে পারে, তার জীবনের উদ্দেশ্য বুঝতে পারে। কারণ যেহেতু তার কোন অর্থনৈতিক সমস্যা নেই। তাই কৃষ্ণভাবনামৃত বা ভগবৎচেতনায় মনোনিবেশ করার জন্য তার যথেষ্ট সময় রয়েছে । কিন্তু সে তাতে অংশ নিচ্ছে না। তাই সে মূঢ়। আসলে মূঢ় মানে হচ্ছে গাধা। তার বুদ্ধি অতটা উন্নত নয়। যখন কেউ সমস্ত জড় বাসনাগুলো ত্যাগ করেন, তখনই কেবল তাকে যোগারূঢ় বলা হয়। যদি কেউ যোগসিদ্ধি লাভ করেন, তখন তিনি সন্তুষ্ট হন। তাঁর আর কোন জড় বাসনা থাকে না। তার নাম হচ্ছে সিদ্ধি। তিনি ইন্দ্রিয় সুখভোগের জন্য বা সকাম কর্ম করেন না। সকাম কর্মও, সকাম কর্ম মানে হচ্ছে ইন্দ্রিয় সুখভোগের জন্য উপার্জন করা। কোন ব্যক্তি বাস্তবে ইন্দ্রিয়সুখ ভোগে লিপ্ত, আর ইন্দ্রিয়সুখভোগের জন্যই অর্থ সংগ্রহে ব্যস্ত।

সুতরাং সকাম কর্মকাণ্ড, বা ধরা যাক পুণ্য কর্ম। বৈদিক শাস্ত্র অনুযায়ী এবং সর্বত্রই পুণ্য কর্মসমূহ যদি তুমি ধার্মিক হও, যদি তুমি অর্থ দান কর, এটি পুণ্য কর্ম। যদি তুমি হাসপাতাল খোলার জন্য, বিদ্যালয় বা বিনামূল্যে শিক্ষাদানের জন্য কিছু অর্থসম্পদ দান কর, তাহলে এসব নিশ্চয়ই পুণ্য কর্ম হবে। কিন্তু এগুলোও ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের জন্য। যেমন ধর, আমি যদি বিনামূল্যে শিক্ষার জন্য কিছু দান করি, তাহলে আমি পরবর্তী জন্মে ভাল শিক্ষা সুবিধা পাব, আমি উচ্চ শিক্ষা লাভ করব বা উচ্চশিক্ষা পেয়ে বড় পদে চাকুরি পাব। কিন্তু এসবের পরিণামে কি হবে? যদি আমি একটি ভাল পদ বা অবস্থা পাই, আমি সেটিকে কিভাবে কাজে লাগাই? ভালো করে ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের জন্য। ব্যাস। কারণ আমি এ ছাড়া আর কিছুই জানি না। এসব হচ্ছে সকাম কর্ম। যদি আমি স্বর্গে যাই, আমি কিছুটা উন্নত ধরণের জীবন পাব। যেমন ধর, তোমাদের আমেরিকাতে ভারতের চেয়ে কিছুটা উন্নত মানের জীবনযাত্রা রয়েছে। কিন্তু এই 'উন্নত মানের জীবনযাত্রা'-র মানে কি? সেই একই আহার, নিদ্রা, কিছুটা উন্নতভাবে। ব্যাস। তুমি এর চেয়ে বেশি আর কিছুই করছ না। ওরাও খাচ্ছে। তারা কিছু নিকৃষ্ট মানের শস্য খাচ্ছে, তুমি খুব দামী কিছু খাচ্ছো। কিন্তু ব্যাপারটা তো আহার করাই। এর বাইরে তো কিছু নয়। তাই আমার এই উন্নত মানের জীবন মানে কোন পারমার্থিক উপলব্ধি নয়। উন্নত মানের আহার, নিদ্রা, মৈথুন। ব্যাস। সুতরাং এসব হচ্ছে সকাম কর্ম। সকাম কর্মও হচ্ছে আরেক ধরণের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি, এর ভিত্তি হচ্ছে ইন্দ্রিয় সুখ। আর যোগ মানে হচ্ছে পরমেশ্বরের সাথে যুক্ত হওয়া। ঠিক যখনই পরম বস্তুর যুক্ত হওয়া যাবে, তৎক্ষণাৎ, ঠিক যেমন ধ্রুব মহারাজের ন্যায়। তিনি যখনই ভগবান শ্রীনারায়ণের দর্শন পেলেন, ভগবাকে দর্শন করার জন্য তিনি অত্যন্ত কঠোর তপস্যা এবং কৃচ্ছতার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। তিনি দর্শন পেলেন। কিন্তু তিনি যখন দর্শন পেলেন, তিনি বললেন, স্বামীন্ কৃতার্থোহস্মিন্ বরং ন যাচে। (চৈতন্য চরিতামৃত ২২.৪২) "হে ভগবান, আমি সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট। আমি আপনার কাছে কিছুই চাই না। কোনও বরই প্রার্থনা করি না।" কারণ প্রকৃত আশির্বাদটি কি? আশির্বাদ মানে তুমি কোন ভালো রাজ্য পেলে বা খুব সুন্দরী স্ত্রী পেলে, অথবা ভালো ভালো খাবার পেলে। আমরা এসব বস্তুকে আশির্বাদ মনে করি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যখন কেউ ভগবানের সঙ্গে যুক্ত হন, তখন তিনি এসব কিছুই আর চান না। তিনি সন্তুষ্ট। পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট। স্বামীন্ কৃতার্থোহস্মিন্ বরং ন যাচে। (চৈতন্য চরিতামৃত ২২.৪২)

আমি তোমাদের ধ্রুব মহারাজের লীলাটি বহুবার বলেছি। তিনি মাত্র পাঁচ বছরের বালক ছিলেন। বিমাতার দ্বারা তিনি খুব অপমানিত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর পিতার কোলে বসেছিলেন বা বসতে চেয়েছিলেন, তখন তাঁর বিমাতা তাঁকে বললেন, "ওহ, তুই তোর পিতার কোলে বসার যোগ্য নস। কারণ তোর জন্ম আমার গর্ভে হয় নি।" তাই যদিও তিনি মাত্র পাঁচ বছরের বালক ছিলেন, কিন্তু যেহেতু তিনি ক্ষত্রিয় ছিলেন তাই তিনি তাতে খুব অপমানিত বোধ করলেন। তিনি তাঁর মায়ের কাছে গিয়ে বললেন, "মা, বিমাতা আমাকে এ ভাবে অপমানিত করেছেন।" তিনি কাঁদছিলেন। মা বললেন, "হে প্রিয় পুত্র, আমি কি করতে পারি বল?" তোমার পিতা তোমার বিমাতাকে অধিক ভালোবাসেন। আমি কি করতে পারি?" "না, আমি আমার পিতার সাম্রাজ্য পেতে চাই। আমাকে বল আমি তা কিভাবে পেতে পারি"। মা বললেন, "হে পুত্র, যদি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আশির্বাদ করেন, তবেই কেবল তুমি তা পেতে পার"। "ভগবান কোথায়?" তিনি বললেন, "ওহ, আমরা শুনেছি ভগবান বনে থাকেন। বড় বড় মুনিঋষিরা তাঁকে বনে গিয়ে অন্বেষণ করেন।" সুতরাং তিনি বনে গিয়ে কঠোর তপস্যা করলেন এবং ভগবানের দর্শন লাভ করেন। কিন্তু যখন তিনি ভগবানের দর্শন পেলেন, তিনি আর তাঁর পিতার সাম্রাজ্যের জন্য লালায়িত ছিলেন না। আর কোন বাসনা ছিল না। তিনি বললেন, "হে প্রভু, আমি সন্তুষ্ট, সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট"। আমি আর কোনও সাম্রাজ্য, আমার পিতার রাজ্য কিছুই চাই না।" তিনি উপমা দিলেন যে, "আমি কিছু কাঁচের টুকরো খুঁজছিলাম, কিন্তু আমি অমূল্য রত্ন পেয়ে গিয়েছি"। তার মানে হচ্ছে তিনি অধিকতর সন্তুষ্ট হলেন। যখন তুমি প্রকৃত অর্থেই তোমাকে ভগবানের সঙ্গে যুক্ত করবে, তখন তুমি এই জড় জগতকে ভোগ করার আনন্দের চেয়ে কোটিগুণ অধিক আনন্দ ও তৃপ্তি লাভ করবে। সেটিই হচ্ছে ভগবৎ উপলব্ধি। আর সেটিই হচ্ছে যোগের সার্থকতা।